আইএমএফ’র ঋণের প্রশ্নে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম

পতিত ও বিতাড়িত সরকার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে বেশ কিছু অন্যায্য ও জনস্বার্থবিরোধী শর্ত মেনে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএফএফ)’র কাছ থেকে ঋণ নেয়। ২০২২ সালের আগস্টে সরকার ঋণ সহায়তা চায়। এই ঋণ সহায়তাকে পুনরুদ্ধার বলা হয়। আইএমএফ সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে ঋণের বিপরীতে কঠিন শর্ত আরোপ করে ঋণ সহয়তা দিতে রাজি হয়। সে মোতাবেক ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারিতে আইএমএফ’র সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয় এবং চুক্তির তিন দিনের মধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ বাবদ ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার লাভ করে । ওই বছর ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার সরকার পায়। চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের কথা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটলে ওই অর্থ ছাড় আটকে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার ও আইএমএফ’র মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করার কথা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার ও রবিবার আইএমএফ’র দুটি প্রতিনিধি দল ঢাকা এসেছে। আইএমএফ’র এই মিশন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে এবং ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরবে। সরকারপক্ষও তার বক্তব্য উপস্থাপন করবে। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, আইএমএফ’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে যেসব শর্ত আরোপিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যায্য ও জনস্বার্থবিরোধী শর্তও আছে। তখনই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। কিন্তু সরকার তা তোয়াক্কা করেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ওইসব শর্ত বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়। সরকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইএমএফ’র সঙ্গে এ ব্যাপারে দরকষাকষি করতে চায়। এর ওপর ঋণ চুক্তির ভষ্যিৎ অনেকটাই নির্ভর করছে। বর্তমান সরকার চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নে এমন কিছু করতে চায় না, যাতে জনদুর্ভোগ বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। আইএমএফ’র একটি শর্ত হলো- ডলারের দাম বাড়ানো অর্থাৎ টাকার মান কমানো। আইএমএফ’র যুক্তি: বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনায় ডলারের দাম এখানো কম। ডলারের দাম বাড়ানো হলে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি ডলার ধরে রাখার প্রবণতা কমবে। বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়বে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য: ডলারের দাম বাড়লে টাকার মান কমবে। এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। টাকার মান কমায় ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমবে, আমদানি ব্যয় বাড়বে। আমদানি পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে, দেশি পণ্যের দামও বাড়বে। পাশাপাশি বৈদেশিক দেনার পরিমাণ বাড়বে, রিজার্ভে চাপে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্যের সারকথা হলো, ডলারের দাম বাড়ালে অর্থনীতির যতটা উপকার হবে, ক্ষতি হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো আইএমএফ’র আরেকটি শর্ত। আইএমএফ বলছে: এখাতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়াতে হবে বিদ্যুতের। সরকারের সাফ কথা: বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে শিল্পে ব্যয় বাড়বে, পণ্যের দাম বাড়বে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আইএমএফ’র অন্য একটি শর্ত হলো, কর আদায় বাড়াতে হবে। সরকারের বক্তব্য: জনগণের ওপর চাপ বাড়িয়ে কর আদায় করা যাবে না। তবে করের আওতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

দেখা যাচ্ছে, আইএমএফ’র শর্তে জনস্বার্থের প্রাধান্য কম। পক্ষান্তরে সরকারের বক্তব্যে জনস্বার্থই মুখ্য। সাথে আছে অর্থনীতির বিবিধ বিকাশের কথাও। পর্যবেক্ষকদের মতে, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নীকারী সংস্থার কার্যক্রম বাণিজ্যিক ও শোষণমূলক। তাদের ঋণ বা সহায়তার লক্ষ্য ও শর্ত সে মোতাবেকই হয়ে থাকে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ এবং সহায়তায় কোনো দেশের উন্নয়ন ও বিকাশ তরান্বিত হয়েছে, এমন নজির কমই আছে। অনেকেরই অভিমত, দরিদ্র দেশগুলোর দারিদ্র্যব্যবস্থা যাতে অপরিবর্তিত থাকে, সেটা নিশ্চিত করাই বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি সংস্থার লক্ষ্য। ধনবাদী-সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোর হাতিয়ার হিসেবে এরা কাজ করে। এ সবের পরিচালক ও নীতিব্যবস্থা ধনবাদী-সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে। দরিদ্রদেশগুলোর উন্নয়ন ও বিকাশ তারা ওই পর্যন্তই ধরে রাখতে চায়, যা তাদের শোষণের ও দাবিয়ে রাখার জন্য সহায়ক। দারিদ্র্যের ভূগোল বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। এ ভূগোলের অন্তর্গত দেশগুলোর সমস্যা-সংকটের শেষ নেই। খাদ্যাভাব থেকে শুরু করে জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো তাদের অনেকের কাছেই অধরা। এর ওপর আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুঃসহ পরিস্থিতি, যুদ্ধের কারণে উদ্বান্তু হয়ে যাওয়ার দুর্ভাগ্য ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার নজির আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নীকারী সংস্থাগুলোর কমই আছে। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশ দুর্যোগ-প্রবণ একটি দেশ। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণীঝড়, ইত্যাদি এ দেশে অতি সাধারণ ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিও প্রবল। উপযুক্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা এখানে জরুরি। কিন্তু অর্থাভাবে সেটা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। আইএমএফ’রই একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্যোগ-ঝুঁকি মোকাবিলায় ফান্ডের অভাব রয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০০-২০০৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতি হয় ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৩০ মিলিয়ন মানুষ। দুর্যোগ-ঝুঁকি মোকাবিলায় ফান্ডের যে সংকট রয়েছে, তার জোগান নিশ্চিত না হলে আগামীতে বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক বিপর্যয় বাড়বে। এর জন্য বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার উদার সহযোগিতার আবশ্যকতা প্রশ্নের অতীত। অন্যায্য ও বাস্তবতাবিমুখ শর্তে বেলআউট ঋণ সহায়তায় আইএফএফ যতটা উৎসাহী, দুর্যোগ-ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা দিতে কি তত উৎসাহী?
এই বাস্তবতা সামনে রেখে আইএমএফ’র সফররত মিশনের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচকবৃন্দের অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে কথাবার্তা বলতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ হিসেবে সুখ্যাত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ইতোমধ্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আহসান এইচ মনসুরÑ এই সুযোগ্য টিম স্বৈরাচার-উত্তর ভগ্ন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তার সাফল্য অভূতপূর্ব। অর্থনীতির বিবিধ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের প্রেক্ষিতে রফতানি ক্ষেত্রে যে আশংকা দেখা দিয়েছে, স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা তা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছন। বলা যায়, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধান উপদেষ্টা যতটা কমিটেড, গণমানুষের কল্যাণেও তার সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। এমতাবস্থায় আইএমএফ’র ঋণের শর্ত ও তা বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার স্ট্রং লাইন মেইনটেন করবে বলে পর্যবেক্ষকরা আশা করেন। আইএমএফ’কে তোয়াজ করার দরকার নেই, তাদের স্পষ্ট অভিমত এটাই।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি দিন নয়
সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে
শুভ নববর্ষ
আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব
আরও
X

আরও পড়ুন

র‍্যাংগস ই-মার্টে শুরু হলো এসি কার্নিভাল

র‍্যাংগস ই-মার্টে শুরু হলো এসি কার্নিভাল

ঈদুল ফিতরে ২১ হাজার উদ্যোক্তাকে ডিজিটাল রূপান্তরে সহায়তা করলো জাতিকইজি

ঈদুল ফিতরে ২১ হাজার উদ্যোক্তাকে ডিজিটাল রূপান্তরে সহায়তা করলো জাতিকইজি

‘মঙ্গল’ নাম বদলে ক্ষোভ, ব্যাখ্যা চান চারুকলার শিক্ষার্থীরা

‘মঙ্গল’ নাম বদলে ক্ষোভ, ব্যাখ্যা চান চারুকলার শিক্ষার্থীরা

এক হাজার শয্যার আধুনিক হাসপাতাল উপহার দিচ্ছে চীন

এক হাজার শয্যার আধুনিক হাসপাতাল উপহার দিচ্ছে চীন

২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল রিজার্ভ

২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল রিজার্ভ

বৈশাখের কালো ঘোড়া

বৈশাখের কালো ঘোড়া

কালবৈশাখী

কালবৈশাখী

বৈশাখ

বৈশাখ

আচানক এইসব দৃশ্য

আচানক এইসব দৃশ্য

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

নারায়ণগঞ্জে আরসা প্রদানসহ ছয় জনের ফের আট দিনের রিমান্ডে

নারায়ণগঞ্জে আরসা প্রদানসহ ছয় জনের ফের আট দিনের রিমান্ডে

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ সরদার বকুলের বিরুদ্ধে

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ সরদার বকুলের বিরুদ্ধে

ভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকিভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকি

ভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকিভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকি

কবিতায় বৈশাখ

কবিতায় বৈশাখ

দ্রুত সময়ে ময়মনসিংহে বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজ শুরু হবে: বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ

দ্রুত সময়ে ময়মনসিংহে বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজ শুরু হবে: বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ

নববর্ষ ও বিজাতীয় আগ্রাসন

নববর্ষ ও বিজাতীয় আগ্রাসন

নানার বাড়ীতে বেড়াতে গিয়ে পুকুরে ডুবে প্রাণ গেলো শিশুর

নানার বাড়ীতে বেড়াতে গিয়ে পুকুরে ডুবে প্রাণ গেলো শিশুর

বাংলা সন ও সাংস্কৃতিক লড়াই

বাংলা সন ও সাংস্কৃতিক লড়াই

মাগুরার চাঞ্চল্যকর আছিয়া ধর্ষন মামলার চার্জশিট দাখিল

মাগুরার চাঞ্চল্যকর আছিয়া ধর্ষন মামলার চার্জশিট দাখিল

‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বিতর্কে তামিলনাডুর রাজ্যপাল

‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বিতর্কে তামিলনাডুর রাজ্যপাল